বৃত্তের বাইরে


মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমরা যারা মানুষ, তাদের সবার মাথার ভেতরটা রেলগাড়ির কম্পার্টমেন্ট-এর মত। একেকটা কম্পার্টমেন্টের একেকটা নাম-কোনোটার নাম ‘ভুল’, কোনোটার নাম ‘সঠিক’, কোনোটার নাম আবার ‘স্বাভাবিক’, কোনোটার নাম ‘অস্বাভাবিক’; এছাড়াও আছে ‘উচিত’ এবং ‘অনুচিত’ নামের দুটো কম্পার্টমেন্ট। আমরা আমদের আশপাশে যা দেখি, যা শুনি, তার মধ্যে সবকিছুকেই আমরা ভাগ ভাগ করে একেকটা তথ্য একেকটা কম্পার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেই। আর কোন তথ্যকে কোন কম্পার্টমেন্টে পাঠাবো, সেটা আমরা শিখি আমাদের আশপাশ থেকে, একটু বুঝতে শেখার বয়স হলেই সবাই আমাদের ধরে ধরে শিখিয়ে দেবে কার কোন আচরণ, পৃথিবীর কোন কোন ব্যপার আমাদের মাথার ভেতরের কোন কম্পার্টমেন্ট এ রাখতে হবে।

তবে, মাথার ভেতর এই খোপ খোপ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ঘোরার ঝামেলাও প্রচুর। সময়ের সাথে সাথে আবেগ- অনুভূতি এবং ইচ্ছে-অনিচ্ছের জটিলতাগুলো যখন বাড়তে থাকে, তখন বোঝা যায়, এতদিনের শেখা ভুল-ঠিক, উচিত-অনুচিতের হিসেবটা আসলে কোনোই কাজের না। আশপাশে সব ছকে বাধা মানুষের ভীরে এমন কাউকেই পাওয়া যায় না যে সারাক্ষণ সারাক্ষণ আমাকে নিয়ম-কানুনের জালে না বেধে শুধু একটু শুনবে, যার উপর একটু নির্ভর করা যায়। সামাজিক জীবনের এ এক অদ্ভূত নিঃসঙ্গতা। শুধুমাত্র এই শূণ্যতা এবং অসহায়ত্বের থেকেই যে ভীষন আশংকাজনক হারে মানুষ নিজের মূল্যবান জীবনটাকে শেষ করে দেয়ার মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটা বললে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না।
আত্মহত্যার ঘটনাগুলো একটু বিশ্লেষণ করলে প্রায় সবগুলোতেই মোটামুটি কমন একটা ব্যপার দেখা যাবে, আর তা হলো, হয়তো এই হতভাগ্য মানুষগুলোর নিজেদের চিন্তা এবং আবেগগুলো বোঝার মত, তাদের পাশে নিঃশর্তভাবে থাকার মত কেউ ছিল না, অথবা তাদের মধ্যে তীব্র এক হতাশা কাজ করেছিল কারণ তারা সমাজের তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষদের মাঝে খাপ খাওয়াতে পারে নি। আর সেজন্যই তাদেরকে চূড়ান্তভাবে ‘মিসজাজ’ করা হয়েছিল অথবা মিসজাজ করা হতে পারে, তারা এমনটা আশংকা করেছিল।

‘কান পেতে রই’ বিশাল কোনো বৈপ্লবিক উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত কোনও হোমড়াচোমড়া সংগঠন না, এখানে আমরা যারা আসি, আমাদের চেষ্টা শুধুমাত্র তাদের পাশে দাঁড়ানো, যারা মনে করছে তাদের কথাগুলো শোনার বা বোঝার মত কেউ আশপাশে এইমূহুর্তে নেই। আমরা প্রবলেম সল্ভার না, ত্রাণ বিতরণকারী না, পরামর্শদাতাও না। আমরা যারা এখানে কাজ করতে এসেছি, তারা প্রায় সবাই বয়সে তরুণ এবুং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এখানে আমরা একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছি, যাতে একাকীত্ব এবং হতাশার মুখে আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্ত নেয়া কাউকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা যায়।

শুনতে খুব সিম্পল মনে হলেও এই স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় কাজ করাটা কিন্তু এতোটাও সহজ নয়। অনেকেই ভাবতে পারে- ‘অন্যের কথা শোনা, এ আর এমন কী? মজার কাজ, এক্সাইটিং কাজ, সবাই পারবে’। মজার ব্যপার হলো আমাদের এই ছোট্ট সংগঠনে কাজ করতে হলেও কয়েক দফা স্ক্রীণিং পার হয়ে আসতে হয়। প্রথমে ইন্টারভিউ, এরপর ট্রেনিং, তারপর নানাবিধ ট্রায়ালিং এর পর গিয়ে কোনো একজন ভলান্টিয়ার তার ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার অনুমুতি পেয়ে থাকে। আরও মজার ব্যপার হল, এতকিছু পার হয়ে আমরা যারা কাজ করতে আসি, তারা কোনো ম্যাটেরিয়ালিস্টিক কিছু পাওয়ার আশায় এসব করি তা কিন্তু নয়। হয়তো আমরা সারাজীবন নিজের পাশে যেমন একজনকে চেয়েছি, অন্য কারো জন্য তেমন কেউ হয়ে ওঠার চেষ্টাই আমাদের এসব করায়।

আমদের ট্রেনিং এর মূল ব্যপারটাই আসলে “unlearn what you have learnt so far”.  শুরুতে যে বললাম, আমাদের পরিবার আর সমাজ আমাদের গোড়াতেই কিছু বাধাধরা মতাদর্শে বিশ্বাসী করে তোলার চেষ্টা করে, সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয়, আমার সাথে যার মতামত মিলবে না, সে ভুল, সে খারাপ; তাকে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এখানে ট্রেনিং এর শর্তই ছিল নিজেদের অর্জন করা এসব পুরনো জ্ঞানকে পুরোপুরি বিদায় জানাতে হবে, অন্তত যতক্ষন আমি আমার কলারের সাথে আছি। কারণ আমার কলার যে কেউ হতে পারে, সে হতে পারে আমার মতই কেউ, কিংবা আমার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন, তার দুঃখ, কষ্ট, আনন্দগুলো আমার পরিচিত পরিমণ্ডলের মানুষগুলোর থেকে একদমই আলাদা হতে পারে। আমার মূল কাজ কলারকে তার কথাগুলো শেয়ার করার সুযোগ করে দেয়া, সেই প্রক্রিয়াতে আমার মূল্যবোধ যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে আমি আমার কলারের ভরসার স্থান হয়ে উঠবো কীভাবে? যে মানুষটা শুধুমাত্র একটা ফোনের মাধ্যমে আমার সাথে সংযুক্ত, যে আমাকে দেখতে পারছে না, স্পর্শ করতে পারছে না তার কাছে কীভাবে নিজেকে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য করে তোলা যায়, একজন অচেনা মানুষ হয়েও কীভাবে তার সাথে শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যমে তাকে কিছুটা নির্ভার করে তোলা যায়, কীভাবে কলারের চোখে কিছুক্ষণের জন্য তার পৃথিবীটাকে দেখা যায়-একটা লম্বা সময় ধরে আমরা সেটাই রপ্ত করি।  

নিজের কথা যদি বলি, কান পেতে রই এর ট্রেনিং পাওয়ার আগে একজন যথেষ্ট ভালো শ্রোতা এবং নন-জাজমেন্টাল, সহমর্মী মানুষ হিসেবে নিজেকে নিয়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু আমি বুঝি নি আমার জানার এবং বোঝার বাইরেও একদম ভিন্ন একটি জগত রয়েছে, যেটি কান পেতে রই-এর নিজস্ব একটা অদ্ভূত জগত। যেখানে নন-জাজমেন্টাল বা সহমর্মী হওয়ার যে স্বাভাবিক একটি সীমা, তা নেই। সেই অদ্ভূত জগতের অংশ হতে গিয়ে বুঝলাম আমার নিজের ভেতর ভালো শ্রোতা, নন-জাজমেন্টাল এবং সহমর্মী হওয়ার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে এবং তা ভাঙাটা সহজ নয়। এই ভাঙচুর যখন নিজের ভেতর চলতে থাকে, তখন অদ্ভুত একধরণের কষ্ট হয়, এমনকি নিজেকেও খুব অচেনা লাগতে থাকে চেনা আমার থেকে। কারণ এতদিন ধরে পৃথিবীকে দেখার আমার যে নিজস্ব একটা প্যাটার্ন আছে তা যেহেতু বদলাতে থাকে, তাই নিজেকে দেখার ধরনেও বদল আসে। তবে একটা সময় পর সবকিছুই খুব সহজাত হয়ে আসে। আমরা কান পেতে রই ভলান্টিয়াররা এই পরিবর্তন আত্মঃস্থ করে ফেলি, তখন আর নিজের পুরনো সত্ত্বায় ফেরা হয় না আমাদের।


পরিশেষে বলতে চাই, কান পেতে রই-এর যাত্রার সাথে আমার জীবনের অন্য কোনো অভিজ্ঞতার একেবারেই তুলনা নেই। এখানে এসে আমি ভিন্নতাকে আপন করতে শিখেছি, জেনেছি বয়সে ছোট কারো থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে নিজের মূল্যবোধ বজিয়ে রেখেই সামনের মানুষের মূল্যবোধকে সম্মান করার শিক্ষা। আর সেটি পেয়েছি এখান থেকেই, যেটা এখন আমাকে একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রেও সহায়তা করে যাচ্ছে। প্রায়ই নিজেকে জীবনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বাহবা দিতে ইচ্ছে করে, কান পেতে রই-এ কাজ করার সিদ্ধান্ত অবশ্যই তার মাঝে একটা। কান পেতে রই এর সাথে যুক্ত সকলের জন্য আমার হৃদয়ের গভীরে সবসময় অনেকখানি ভালোবাসা আলাদা করে তোলা থাকে, যাতে অন্য কেউ বা অন্য কিছু তাতে ভাগ না বসাতে পারে। এই লেখার মাধ্যমে আমি সেই ভালোবাসাটি ছড়িয়ে দিতে চাই তাদের মাঝে।

Author Information

Tahneena Mehreinn Anindita 
Assistant Counseling Psychologist
Currently working as a consultant in World Bank Group 

Comments

Popular posts from this blog

আমার প্রিয় ৫০টি বই - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

শেয়ারিং ইজ কিউরিং এবং কান পেতে রই

পাশে থাকতে শেখা - নিজের এবং অন্যের